হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু: তিনি ছিলেন উজ্জ্বল চেহারা, জ্যোতির্ময় ললাট, শীর্ণদেহ, দীর্ঘকায় ও কোমল কপালের...
হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু:
তিনি ছিলেন উজ্জ্বল চেহারা, জ্যোতির্ময় ললাট, শীর্ণদেহ, দীর্ঘকায় ও কোমল কপালের অধিকারী ৷ তাকে দেখে চোখ শান্ত হত ৷ তার সাক্ষাতে হৃদয় সান্ত্বনা পেত ৷ তার সংস্পর্শে অন্তর প্রশান্ত হত ৷ তাছাড়া তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, দারুন লজ্জাশীল ৷ কিন্তু কোন বিষয় প্রকট আকার ধারণ করলে এবং ভয়ঙ্কর রূপ নিলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়া নেকড়ের ন্যায় হয়ে যেতেন ৷
তিনি সৌন্দর্যে ও উজ্জল্যে তরবারীর ফলার ন্যায় ছিলেন ৷ তিক্ষ্ণতা ও প্রখরতার ক্ষেত্রে তিনি তরবারীই উপমা ধারণ করতেন ৷ তিনি হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের বিশ্বস্ত ব্যক্তি ৷ আমের ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে জাররাহ ফিহরী কুরাইশী (রা:) ৷ যার উপনাম আবু ওবায়দাহ ৷
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু তার প্রশংসা করে বলেন, তিন ব্যক্তি চেহারায় ছিলেন সমোজ্জল, চরিত্রে ছিলেন মোহময়, আর লজ্জায় ছিলেন দৃঢ়তর ৷
যদি তারা তোমার সাথে কথা বলেন, তাহলে মিথ্যা বলবেন না ৷ আর যদি তুমি তাদের সাথে কথা বল, তাহলে তোমাকে মিথ্যাবাদী বলবে না ৷ তারা হলেন , আবু বকর সিদ্দিক রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু, উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু
★ ★ ★ ★ ★
হযরত আবু উবায়দা (রা:) ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী ব্যক্তিদের মাঝে ছিলেন ৷ হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ইসলাম গ্রহণের পরদিনই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন৷ তিনি আবু বকর সিদ্দিক রদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর হাতেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ৷ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তাকে, আব্দুর রহমান ইবনে আউফকে, ওসমানকে ইবনে মাযউনকে এবং আরকাম ইবনে আবুল আরকামকে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গেলেন ৷ তারা তার সামনে চিরন্তন সত্যের কালিমা পাঠ করলেন ৷ তাই তারা ছিলেন প্রথম বুনিয়াদ যার উপর ইসলামের মহান প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছে ৷
আবু উবায়দা (রা:) মক্কায় শুরু থেকেশেষ পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে নিপীড়ণের পরীক্ষাক্ষেত্র হয়ে রইলেন এবং অগ্রগামী মুসলমানদের সাথে এমন দুঃখ -বেদনা, কষ্ট -যাতনা ও নির্যাতন -নিপিরণের প্রচন্ডতা সহ্য করলেন যা পৃথিবীর বুকে অন্য কোন ধর্মের অনুসারীরা সহ্য করেনি ৷ তিনি পরীক্ষার সম্মুখে অটল-অবিচল রইলেন এবং সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে সত্যরূপে মেনে নিলেন ৷
কিন্তু বদরের দিনে তার পরীক্ষার প্রচন্ডতার মাত্রা কল্পবিলাসীদের কল্পনা ছাড়িয়ে গেছে, অনুমান কারীদের অনুমানের উর্ধ্বে চলে গেছে ৷
★ ★ ★ ★ ★
বদরের দিনে হযরত আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু নির্ভীক মরণজয়ী যোদ্ধার ন্যায় ব্যুহের পর ব্যুহ ভেদ করে আক্রমণ করতে লাগলেন ৷ ফলে মুশরিকরা ভয় পেয়ে গেল ৷ নিঃশঙ্ক মরণজয়ী যোদ্ধার ন্যায় ঘুরতে লাগলেন ৷ ফলে কোরাইশের অশ্বারোহী যুদ্ধারা ভয় পেয়ে গেল ৷ তারা তার মুখোমুখি হলেই পাশ কেটে যেতে লাগলো ৷
কিন্তু এক ব্যক্তি সবদিক থেকে আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর মুখোমুখি হতে লাগল আর আবু উবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু তার পথ থেকে সরে যেতে লাগলেন ৷ তার মুখ মুখি হতে দূরে থাকতে চাইলেন ৷
লোকটি ভীষণ আক্রমণ করল ৷ আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু তার থেকে দূরে সরে পড়তে চাইলেন ৷ লোকটি আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর সব পথ বন্ধ করে দিলেন এবং তার মাঝে ও আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করে দাঁড়াল ৷ তিনি একেবারে ধৈর্য্য হারা হয়ে তরবারি দিয়ে তার মাথায় এমন আঘাত করলেন যে, তার শির দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল এবং তার সামনে লুটিয়ে পড়ল ৷
প্রিয় পাঠক! লুটিয়ে পড়া এ ব্যক্তটি কে ছিল, তা অনুমান করার কোনো চেষ্টা করো না ৷ আমি কি তোমাকে বলিনি যে, নিপীড়ণের প্রচণ্ডতা কল্পবিলাসীদের কল্পনা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, অনুমান কারীদের অনুমানের উর্ধ্বে চলে গিয়েছিল ৷ বেদনায় তোমার শির ফেটে যাবে যখন তুমি জানতে পারবে, লুটিয়ে পড়া ব্যক্তিটি হলেন আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে জাররাহ ৷
✔ ✔ ✔ ✔ ✔
আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তার পিতাকে হত্যা করেননি, বরং তিনি তার পিতার ব্যক্তিত্বে লুকায়িত শিরককে হত্যা করেছেন ৷ তাই আল্লাহ তাআলা আবু উবাইদা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু ও তার পিতার প্রসঙ্গ টেনে কুরআনে বলেন—
لَّا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ ۚ أُولَٰئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٍ مِّنْهُ ۖ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ۚ
أُولَٰئِكَ حِزْبُ اللَّهِ ۚ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
[ অর্থঃ যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধচারণ কারীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে দেখবেন না ৷ যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই,কিংবা বংশের লোক হয় ৷ তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে তার অদৃশ্য শক্তি দ্বারা শক্তিশালী করেছেন ৷ তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশ দিয়ে নির্ঝরমালা প্রবাহিত ৷ তারা সেখানে চিরকাল থাকবেন ৷ আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট ৷ তারাই আল্লাহর দল ৷ জেনে রাখ, আল্লাহর দল সফলকাম হবে ৷ (সূরা মুজাদালা- 22)]
আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর জন্য এটা কোন বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল না ৷ কারণ আল্লাহর উপর তার ঈমান, দ্বীনের জন্য তার কল্যাণকামিতা, আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের জন্য তার বিশ্বস্ততা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যার প্রতি আল্লাহর অনেক প্রিয় বান্দারা হয়েছিল লোভাতুর ৷
মুহাম্মাদ ইবনে জাফর বর্ণনা করেন,খৃষ্টানদের একটি দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এল ৷ বলল, হে আবুল কাসেম! আপনার সাথীদের মধ্য হতে এমন একজনকে আমাদের সাথে পাঠান যার ব্যাপারে আপনি সন্তুষ্ট হবেন ৷ আমরা কিছু ধন-সম্পদ নিয়ে মতবিরোধ করছি সে আমাদের মাঝে তার ফায়সালা করে দিবে ৷ আর আপনারা তো আমাদের নিকট প্রিয়ভাজন ৷
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা বিকালে আমার নিকট আস, আমি তোমাদের সাথে শক্তিশালী বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠাব ৷
হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন, আমি তাই তাড়াতাড়ি জোহরের নামাজ পড়তে গেলাম ৷ সেদিনই আমি নেতৃত্বকে ভালোবেসেছিলাম ৷ আশা ছিল আমি এ গুণ সম্পন্ন ব্যক্তি হব৷
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহরের নামাজ পড়ালেন ৷ তারপর ডানে ও বামে তাকাতে লাগলেন ৷ আমি তার দৃষ্টির সামনে দীর্ঘ হতে লাগলাম, যেন তিনি আমাকে দেখেন ৷ আর তিনি আমাদের মাঝে তার দৃষ্টি ফেরাতে লাগলেন ৷ অবশেষে আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে দেখলেন ৷ তিনি তাকে ডেকে বললেন, তাদের সাথে যাও, তারা যে বিষয়ে মতবিরোধ করছে ন্যায়সঙ্গত ভাবে তার ফয়সালা কর ৷ আমি তখন বললাম, আবু ওবায়দা তো সে গুণের অধিকারী হয়ে গেল ৷
※ ※ ※ ※ ※ ※
আবু উবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু শুধুমাত্র বিশ্বস্তই ছিলেন না ৷ বিশ্বস্ততার সাথে তিনি শক্তিরও অধিকারী ছিলেন ৷ বেশ কিছু ক্ষেত্রে তার এই শক্তির বিকাশ ঘটেছে ৷ যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের একটি কাফেলার মুখোমুখি হওয়ার জন্য একদল সাহাবীকে পাঠালেন এবং আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু কে তাদের আমির নিযুক্ত করলেন আর পাথেয় স্বরূপ তাদেরকে এক থলে খেজুর দিলেন ৷ দেয়ার জন্য অন্য কিছু পেলেন না, সেদিন তার শক্তির বিকাশ ঘটেছিল ৷
তখন আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু প্রত্যেকদিন তার সাথীদের একটি করে খেজুর দিতেন ৷ প্রত্যেকে তা শিশু মায়ের দুধ চুষে খাওয়ার পর ন্যায় চুষে খেত ৷ তার পর পানি পান করত ৷ এটাই রাত পর্যন্ত তাদের জন্য যথেষ্ট হত ৷
উহুদের দিনে যখন মুসলমানগন পরাজিত হলেন আর মুশরিকরা চিৎকার করে ডাকতে লাগল , মুহাম্মাদ কোথায় আছে দেখিয়ে দাও ,, মুহাম্মদ কোথায় আছে দেখিয়ে দাও ,,,, আবু উবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু তখন ঐ দশজনের একজন ছিলেন যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে মুশরিকদের বর্ষাগুলো নিজ দেহ পেতে প্রতিহত করছিলেন ৷
যুদ্ধ শেষ হলে দেখা গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনের দাঁত ভেঙ্গে গেছে ৷ তার ললাট আক্রান্ত হয়েছে এবং বর্মের দুটি আংটা তার ললাটে বিদ্ধ হয়েছে ৷ আবূ বকর সিদ্দিক রদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তা তার কপাল থেকে তুলে ফেলতে অগ্রসর হলেন ৷ তখন আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু তাকে বললেন আল্লাহর কসম দিয়ে আমি আপনাকে বলছি, অনুগ্রহ করে তা আমার জন্য ছেড়ে দিন ৷ আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তা তার জন্য ছেড়ে দিলেন ৷ আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু ভেবে দেখলেন, যদি তিনি তা হাত দিয়ে উপড়ে ফেলেন তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা কষ্ট দিবে ৷ তাই তিনি সামনের দাঁত দিয়ে একটি আংটা মজবুত করে কামড়ে ধরলেন ৷ তারপর তা তুলে ফেললেন ৷ আর তার সামনের দাঁত পড়ে গেল ৷ অতঃপর সামনের অপর দাঁতটি দিয়ে দ্বিতীয় অাংটাটি কামড়ে ধরলেন ও তা তুলে ফেললেন ৷ ফলে তার সামনে অপর দাঁতটি পড়ে গেল ৷
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তাই বলতেন তাই আবু উবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু সামনের দাঁতহীন মানুষদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর মানুষ ছিলেন ৷
রাসূলের সাহচর্য অবলম্বন করার পর থেকে রাসুলের মৃত্যু পর্যন্ত আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু সবগুলো যুদ্ধেই তার সাথে ছিলেন ৷ সাকাফীর দিনে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহুকে বললেন, আপনার হাত প্রসারিত করুন আমি আপনার বাইয়াত গ্রহণ করব৷ কারণ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, "নিশ্চয় প্রত্যেক জাতির এক বিশ্বস্ত লোক থাকে আর তুমি হলে এ জাতির বিশ্বস্ত ব্যক্তি "৷
তখন হযরত আবু ওবায়দা আল্লাহ তা'আলা আনহু বললেন, আমি এমন দুঃসাহসী নয় যে, ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে তার সম্মুখে অগ্রসর হবো যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজে আমাদের ইমাম হতে নির্দেশ দিয়েছেন ৷ অতঃপর তিনি আমাদের ইমাম হয়েছেন ৷
তারপর তিনি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর হাতে বায়াত গ্রহণ করলেন৷ তাই আবু উবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু সত্যের ক্ষেত্রে তাঁর জন্য ছিলেন উত্তম উপদেশ দানকারী আর কল্যাণের ক্ষেত্রে তার জন্য ছিলেন উত্তম সাহায্যকারী ৷
অতঃপর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করলে আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু তার অনুগত হয়ে রইলেন ৷ মাত্র একবার ছাড়া কখনও তাঁর অবাধ্য হননি ৷
তুমি কি জান? কোন বিষয়টির ক্ষেত্রে আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু খলীফাতুল মুসলিমীন এর নির্দেশের অবাধ্য হয়েছিলেন?! তা তখন ঘটেছিল যখন আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু শামে ছিলেন ৷ এক রণক্ষেত্র বিজয় লাভ করার পর আরেক রণক্ষেত্র বিজয় করার জন্য মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে ছুটে চলছিলেন ৷ ফলে আল্লাহ তাআলা তার হাতে শামের সবগুলো দেশ বিজয় করলেন ৷ পূর্বে ফোরাত নদী আর উত্তরে এশিয়া মাইনরে পৌঁছে গেলেন ৷
তখন সহসা শামে এমন মহামারী দেখা দিলো যার মত ভয়ংকার মহামারী মানুষ কখনো দেখেনি ৷ ফলে মহামারীতে অগণিত মানুষ মৃত্যুবরণ করতে লাগল ৷ হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এ সংবাদ শুনেই সংবাদপত্রসহ একজন দূত আবু ওবায়দা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর নিকট পাঠিয়ে দিলেন ৷ তিনি তাতে লিখলেন—
"তোমার নিকট আমার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তুমি ছাড়া আর কারো দ্বারা তা পূরণ হবার নয় ৷ যদি আমার পত্র তোমার নিকট রাতে এসে পৌঁছে, তাহলে আমি তোমাকে কসম দিয়ে বলছি, তুমি আমার নিকট আসার পথে অশ্বারোহণ ছাড়া সকাল করবে না ৷ আর যদি তোমার নিকট দিনে পৌঁছে , তাহলে আমি তোমাকে কসম দিয়ে বলছি, আমার নিকট আসার পথে অশ্বারোহণ ছাড়া সন্ধ্যা করবেনা " ৷
আবু উবাইদা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু ওমর ফারুক রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর পত্র নিয়ে বললেন, আমার নিকট আমীরুল মুমিনীনের প্রয়োজনের বিষয়টি বুঝে ফেলেছি ৷ তিনি তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাচ্ছেন যে বাঁচবে না ৷ তারপর পত্রের উত্তর লিখে পাঠালেন—
"হে আমীরুল মুমিনীন! আমার নিকট আপনার কি প্রয়োজন আমি তা বুঝে ফেলেছি ৷ আমি মুসলমানদের মুজাহিদ বাহিনীতে রয়েছি৷ আর আমি যে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হব তা থেকে বাচার আমার কোন আগ্রহ নেই ৷ আল্লাহ আমার ও তাদের মাঝে ফয়সালা করার পূর্বে আমি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না ৷
সুতরাং আমার উত্তরপত্র আপনার নিকট পৌছালে আপনার প্রতিজ্ঞা থেকে আমাকে মুক্তি দিন এবং আমাকে শামে থাকার অনুমতি প্রদান করুন "৷
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু উত্তরপত্র পাঠ করে কেঁদে ফেললেন ৷ তার চোখ উপচে অশ্রু প্রবাহিত হলো ৷ তখন তার কান্নার প্রবণতা দেখে মজলিসে উপস্থিত ব্যক্তিরা বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আবু উবাইদা কি মৃত্যুবরণ করেছেন? হযরত উমর রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন, না তিনি মৃত্যুবরণ করেন নি; তবে তার মৃত্যু অদূরে৷
হযরত ওমর ফারুক রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর ধারণা মিথ্যা হয়নি ৷ কেননা শীঘ্রই তিনি মহামারীতে আক্রান্ত হলেন৷ অতঃপর যখন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলো তিনি মুজাহিদ বাহিনীকে ওসিয়ত করে বললেন—
"আমি তোমাদের এমন একটি ওসিয়ত করব তোমরা যদি তা গ্রহণ কর তবে সর্বদা কল্যাণে থাকবে ৷
তোমরা সালাত কায়েম করো ৷ রমজান মাসে রোজা রাখো ৷ দান -সদকা করো ৷ হজ্জ ও উমরা আদায় কর৷ একে অপরকে কল্যাণের অসিয়ত করো ৷ তোমাদের শাসকদের কল্যাণ কামনা কর৷ স্বার্থ অর্জনের জন্য তাদের নিকট যেও না ৷ আর দুনিয়া যেন তোমাদের উদাস করে না ফেলে ৷ কারণ যদি কোন মানুষকে হাজার বৎসরের আয়ু প্রদান করা হয় তাহলেও তাকে অবশ্যই আমার এই স্থানে পৌঁছতে হবে যেখানে তোমরা আমাকে দেখছো ৷ ... আসসালামু আলাইকুম ওরাহমাতুল্লাহ ৷
তারপর মুয়াজ ইবনে জাবাল রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর দিকে ফিরে তাকালেন৷ বললেন, হে মুয়াজ! ইমাম হয়ে লোকদের নামাজ পড়াও ৷ এর অনতিকাল পরেই তাঁর পবিত্র আত্মা উড়ে গেল ৷ তখন মুয়াজ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু দাঁড়িয়ে বললেন—
"হে লোকেরা! নিশ্চয় তোমরা আজ এমন এক মহান ব্যক্তিকে হারিয়ে ব্যথিত হয়েছো, আল্লাহর কসম করে বলছি! আমি জানিনা তার চেয়ে অধিক পুণ্যবান হৃদয়ের অধিকারী, তার চেয়ে অধিক হিংসা-বিদ্বেষ দূরবর্তী ব্যক্তি, শেষ শুভ পরিনামের ব্যাপারে তার চেয়ে অধিক কাঙ্খিত ব্যক্তি এবং তার চেয়ে অধিক জনকল্যাণকামী ব্যক্তি দেখছি কি না? সুতরাং তোমরা তার জন্য রহমতের দোয়া কর ৷ আল্লাহ তোমাদের উপর রহমত বর্ষণ করবেন ৷
COMMENTS