একেই বলে খাটি তাওবা: হিজরতের পর আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে গড়ে উঠেছে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ৷ মদিনার আনসারগণ মুহাজিরদের জন্য ত্যাগ ও কুরবান...
একেই বলে খাটি তাওবা:
হিজরতের পর আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে গড়ে উঠেছে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ৷ মদিনার আনসারগণ মুহাজিরদের জন্য ত্যাগ ও কুরবানীর অপূর্ব নজির পেশ করেছেন ৷ তাদের আরাম ও শান্তির জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান সহ সকল ধরনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন ৷ এমনকি একাধিক স্ত্রী থাকলে মুহাজির ভাইয়ের পছন্দমত কোন একজনকে তালাক দিয়ে তাকে তার হাতে তুলে দেয়ার আগ্রহ পেশ করেছেন ৷ মোটকথা মক্কা থেকে আগমনকারীদের কোন প্রকার কষ্ট -অসুবিধা যাতে না হয় সেদিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি রেখে চলছেন মদিনার আনসারগণ ৷আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৷ তিনি একজন মুহাজির কে একজন আনসারীর ভাই বানিয়ে দিয়েছিলেন৷ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই সিদ্ধান্তকে আনসারগণ এতটাই আনন্দচিত্তে গ্রহণ করেছিলেন যে, পূর্বে কারও দুই ভাই থাকলে এখন তিনি মনে করতেন যে, আমার ভাই তিনজন ৷ এক কথায় আনসারগণ মুহাজিরদেরকে আপন ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা, ভক্তি ও সম্মান দিতেন ৷
সাঈদ ইবনে আব্দুর রহমান ছিলেন মুহাজির সাহাবী ৷ হিজরতের পর তিনি ও সালাবাতুল আনসারী রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর মাঝে সৃষ্টি হয় ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ৷ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাবুক অভিযানে গেলেন, তখন তার সাথে গমন করেছিলেন হযরত সাঈদ ইবনে আব্দুর রহমান (রা:) আর সালাবাতুল আনসারী রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু পেয়েছিলেন সাঈদ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর বাড়ি-ঘর দেখাশোনার দায়িত্ব ৷ সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু সাঈদ (রা:) এর বাড়িতে আসতেন ৷ খোঁজখবর নিতেন ৷ কোন কাজ থাকলে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করতেন ৷
একদিনের ঘটনা:
সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু সাঈদ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর বাড়ি আসলেন৷ খোঁজখবর নিলেন ৷ এ সময় বাড়িতে সাঈদ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর সুন্দরী স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিলনা ৷ এ সুযোগে সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু কে অভিশপ্ত শয়তান ফুসলাতে লাগল ৷ বারবার ধোঁকা দিল ৷ হযরত সা'লাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু শয়তানের ধোঁকায় পড়ে গেলেন ৷ তিনি অগ্র-পশ্চাত না ভেবে পর্দা সরিয়ে ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন ৷ অতঃপর সাঈদ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর স্ত্রীর হাত স্পর্শ করলেন ৷
এ অপ্রত্যাশিত অস্বাভাবিক আচরণে সাঈদ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর স্ত্রীর বুক থর থর করে কেঁপে ওঠে ৷ শিউরে উঠে তার শরীর ৷ বিবর্ণ হয়ে উঠে মুখমণ্ডল ৷ চোখদুটোতে ফুটে উঠে ভয়ার্ত ভাব ৷ তিনি বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললেন, হে আল্লাহর বান্দা! আপনার যে ভাই খোদার রাহে জিহাদে গিয়েছেন আপনি কি তার আমানতের খেয়ানত করতে উদ্যত হয়েছেন?
এতোটুকু কথা সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর অন্তরে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু করল ৷ একটা অভূতপূর্ব আলোড়ন দোলা দিয়ে গেল তার হৃদয় মনে ৷ কেঁপে উঠল অন্তরাত্মা ৷ তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন ৷ ভুল বুঝতে পেরে তিনি এক মুহূর্ত বিলম্ব করলেন না ৷ সাথে সাথে ক্ষমা ক্ষমা বলে চিৎকার করে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন ৷ বারবার প্রচন্ড আওয়াজে বলতে লাগলেন , ইলাহি আমি পাপী ৷ আমি গুনাহগার ৷ কিন্তু তুমি ক্ষমাশীল, দয়াবান ৷
ঘটনার কয়েকদিন পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযান শেষে সাহাবিদের নিয়ে মদীনায় আসলেন ৷ তখন মদিনায় যারা ছিলেন তাদের সকলেই গাজী ভাইদের সংবর্ধনার জন্য এগিয়ে এলেন ৷ কিন্তু সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু কে কোথাও দেখা গেলনা ৷ তিনি ক্ষমা প্রাপ্তির আশায় পাগলের ন্যায় এদিক সেদিক উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরতে লাগলেন ৷ সাঈদ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু বাড়ি এসে সবকিছু শুনলেন ৷ সালাবা রাযিআল্লাহ তা'আলা আনহু এর উপর অসন্তুষ্ট হলেন ৷ কিন্তু যখন তিনি ক্ষমা প্রাপ্তির ব্যাপারে তার নজিরবিহীন অস্থিরতার কথা শুনলেন তখন তার রাগ পড়ে গেল ৷ তিনি ভাবলেন, শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সালাবা এমনটি করতে উদ্যত হয়েছিলেন ৷ সুতরাং এখন তার অনুসন্ধান করা দরকার ৷
সাঈদ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু রাযিআল্লাহু সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু কে এখানে-সেখানে সর্বত্র খুঁজে ফিরলেন ৷ অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে পেয়ে বললেন, ভাই সালাবা! তুমি আমার সঙ্গে চলো ৷ আমরা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি ৷ সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন, না আমি এভাবে যাব না ৷ যদি তুমি আমার হাতকে ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে সেই রশি ধরে আমাকে একটি অপমানিত গোলামের ন্যায় টেনে নিয়ে যাও তবেই আমি যাব অন্যথায় নয় ৷
এরূপ করার কোন প্রয়োজন নেই ৷ তুমি আমার সাথে এমনি চলো ৷
: না ভাই! এভাবে আমি যাব না ৷ যেতে পারি না ৷ কারণ আমি যে মারাত্মক পাপ করেছি তার পরিণতি আমি দুনিয়াতে ভোগ করতে চাই, আখেরাতে নয় ৷
: মাফ করে দিলে তো সেই পাপের ফল ভোগ করার কোন প্রয়োজন থাকে না ৷
: তা অবশ্য ঠিক ৷ কিন্তু আমি তোমার আমানতে হাত দিয়ে যে জঘন্য অপরাধ করেছি, তার অপমানজনক শাস্তি ভোগ না করলে আমার অস্থির মন কখনোই শান্ত হবে না ৷ অতএব, আমাকে নিতে চাইলে আমি যেভাবে বলেছি সেভাবেই তোমাকে নিতে হবে ৷
সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর দৃঢ়তায় সাঈদ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু বিপদে পড়লেন ৷ শেষ পর্যন্ত অপারগ হয়ে তিনি তাই করলেন ৷ সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু হাত ঘাড়ের সাথে বাঁধা অবস্থায় সর্বপ্রথম হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর কাছে পৌছলেন ৷ বললেন, আমি এরূপ পাপ করেছি ৷ আমার এই অন্যায়ের জন্য তাওবার কোন ব্যবস্থা আছে কি?
ঘটনা শুনে উমর রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর সুন্দর মুখমণ্ডল রাগে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে ৷ উজ্জ্বল দীপ্ত চোখ দুটোতে যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে৷ অধর দংশন করেন তিনি ৷ অবশেষে দাঁতে দাঁত পিষে বলেন, বেরিয়ে যাও এখান থেকে ৷ আমার নিকট তোমার কোন তওবার ব্যবস্থা নেই ৷
এরপর তারা হাজির হলেন, হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর দরবারে ৷ তাঁর নিকট সমস্ত ঘটনা খুলে বলার পর তওবার পন্থা বাতলানোর অনুরোধ করলে তিনিও তা প্রত্যাখ্যান করেন ৷
সেখান থেকে নিরাশ হয়ে তারা হযরত আলী রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর দরবারে পৌছলেন ৷ কিন্তু তিনিও তাদেরকে নিরাশ করে ফিরিয়ে দিলেন ৷ বললেন, আমার নিকট তোমার জন্য তওবার কোন ব্যবস্থা নেই ৷
তারপর সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এক বুক আশা নিয়ে দয়ার সাগর রহমাতুল্লিল আলামীন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন ৷ তিনি ভাই সাঈদকে সম্বোধন করে বললেন, ভাই সাঈদ! আশাকরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিরাশ করবেন না ৷ সেখানে যাওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে তাকালেন ৷ বললেন, তুমি তো আমাকে দোযখের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছো ৷ তখন সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু বিনীত কন্ঠে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল আমার পিতা মাতা আপনার উপর কোরবান হোক ৷ আমি আমার মুহাজির ভাইয়ের স্ত্রীর হস্ত স্পর্শ করেছি ৷ এজন্য আমি অনুতপ্ত ৷ চরমভাবে লজ্জিত ৷ আমি তওবা করতে চাই ৷ আমার তওবার কোন ব্যবস্থা আছে কি?
সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর গুরুতর অপরাধের কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সীমাহীন বিস্মিত হলেন ৷ তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে ক্রুদ্ধভাব ৷ তিনি কঠিণ কণ্ঠে বললেন, সালাবা এখান থেকে বেরিয়ে যাও ৷ তোমার জন্য তওবা নেই ৷
সর্বশেষ আশ্রয়স্থল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে থেকে নিরাশ হয়ে সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু আরো বেশি অস্থির হয়ে পড়লেন ৷ মনের অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে মুখভাবে ৷ এবার কি করবেন তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না ৷ চরম পর্যায়ের পেরেশান হয়ে কখনো মাথার চুল টানছেন ৷ কখনও বা অধর দংশন করে চলছেন ৷
এ অবস্থায় চলে গেলো বেশ সময় ৷ অতঃপর এক পর্যায়ে তিনি কি যেন ভেবে পাহাড়ের দিকে দৌড়ে পালালেন ৷ তারপর উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন—
হে দয়াময় প্রভু! আমি ওমরের নিকট হাজির হয়েছি, তিনি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন ৷ আমি আবু বকর ও আলীর নিকট উপস্থিত হয়েছি, তারাও আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ৷ সর্বশেষ আমি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে বড় আশা নিয়ে হাজির হয়েছি, কিন্তু তিনিও আমাকে নিরাশ করেছেন ৷
কিন্তু হে দিন দুনিয়ার প্রভু! তুমি আমার মালিক, আর আমি তোমার গোলাম ৷ তোমার সুমহান -সুউচ্চ দরবারে তোমার গোলাম হাজির হয়েছে ৷ যদি তুমি আমাকে ক্ষমা করো তবে আমার খুশির সীমা থাকবেনা ৷ আর যদি তুমিও আমাকে নিরাশ করো তবে আমার ন্যায় হতভাগা আর কেউ নাই ৷
এসব কথা বলে তিনি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন এবং ছোট্ট শিশুর মতো আকুলভাবে ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে ফিরতেন ৷
একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে একজন ফেরেশতা হাজির হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ পাক আপনাকে জিজ্ঞেস করেছেন, এই বিশ্বজগত সমগ্র মানবজাতিকে কি তিনি সৃষ্টি করেছেন না আপনি?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিঃসন্দেহে সবকিছুর স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা ৷ এরপর ফেরেশতা বললেনঃ আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করেছি, এ সংবাদ তাকে পৌঁছে দিন ৷
ক্ষমার ঘোষণায় অপরিসীম আনন্দ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনে দোলা দিয়ে যায় ৷ তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে একটা অনাবিল মধুর হাসি ৷ তিনি বললেন, এমন কে আছে, যে সালাবাকে আমার নিকট নিয়ে আসবে?
হযরত আবু বকর ও উমর রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু সেখানেই ছিলেন ৷ তারা তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তাকে নিয়ে আসি ৷ এমন সময় হযরত আলী ও হযরত সালমান ফারসী রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু বলে উঠলেন,হে আল্লাহর নবী! সালাবাকে আমরা নিয়ে আসি ৷ রাসুল সাঃ তাদেরকে অনুমতি দিলেন ৷
অনুমতি পেয়ে হযরত আলী ও হযরত সালমান ফারসী রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু দেরি করলেন না ৷ তারা সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন ৷ তালাশ করলেন মদিনার পথে প্রান্তরে ৷ অলিতে-গলিতে ৷ কিন্তু না তাকে কোথাও পাওয়া গেল না ৷ অবশেষে মদীনার উপকণ্ঠে কৃষি কর্মে লিপ্ত লোকদেরকে তারা জিজ্ঞেস করলেন ৷ জবাবে কৃষকরা বলল, আপনারা কি জাহান্নাম থেকে পলায়ন কারী ব্যক্তির সন্ধান করছেন? তাঁরা বললেন হ্যাঁ ৷
তখন কৃষকদের একজন বলল, তিনি রাত্রিকালে এখানে আসেন ৷ এ বৃক্ষ তলে উপস্থিত হয়ে উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ৷ দু চোখ থেকে দরদর করে ঝরে পড়ে অশ্রুধারা ৷
হযরত আলী ও সালমান ফারসি রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু তাই নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলেন ৷ যখন রাত হল তখন সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু সেই বৃক্ষের নিচে উপস্থিত হলেন ৷ তারপর মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন৷
রাতের নিকষ কালো গাঢ় অন্ধকারে এতক্ষণ তারা সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু কে দেখতে পাননি ৷ যখন তিনি ভূপৃষ্ঠের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন, তখন তারা কান্নার আওয়াজ বুঝতে পারলেন যে, নিশ্চয়ই সালাবা এসেছেন ৷ আর এ কান্নার করুণ সুর তার হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হচ্ছে ৷ তারা দ্রুতপদে সেদিকে গেলেন ৷ যেদিক থেকে মর্মস্পর্শী কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল ৷ নিকটে গিয়ে তারা ডাকলেন ৷ সালাবা! মস্তক উত্তলোন কর ৷ কান্না থামাও ৷ আল্লাহপাক তোমাকে ক্ষমা করেছেন ৷
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর পেয়ারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আপনারা কি অবস্থায় দেখে এসেছেন?
তাঁরা বললেন, আমরা তাকে এমন অবস্থায় দেখে এসেছি, যেমন আল্লাহ পাকের পছন্দ ও তোমার আন্তরিক কামনা ৷
তারপর তাকে নিয়ে তারা মসজিদে নববীতে হাজির হলেন, তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে৷ হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ইকামত বলছেন ৷ এখনই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীরে তাহরীমা বেঁধে নামাজ শুরু করবেন ৷ তারা তিনজন সর্বশেষ কাতারে শরিক হলেন৷
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন সূরা ফাতিহা শেষ করে সুরা তাকাসুর শুরু করলেন ৷ হযরত সা'লাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু সুরার প্রথম অংশটুকু শ্রবণ করতেই চিৎকার দিয়ে উঠলেন ৷ যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম "হাততা -যুরতুমুল মাকাবীর" পর্যন্ত পৌছলেন তখন তিনি আরও একটি বিকট চিৎকার দিয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন ৷
নামাজ শেষে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর নিকট এলেন ৷ হযরত সালমান ফারসী রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহুকে বললেন , তার মুখে একটু পানির সিটা দাও ৷ সালমান ফারসী রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সালাবা আর এ জগতে নেই ৷ সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে ৷
এমন সময় সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর কন্যা এসে তার মৃতদেহ দেখে কাঁদতে লাগলো ৷ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—
হে খামসানা! তুমি এতে খুশি নও যে, আমি তোমার পিতা হই এবং ফাতেমা হবে তোমার বোন? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি অবশ্যই রাজি আছি ৷
জানাযা শেষে সালাবা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু এর লাশ কবর স্থানে পৌঁছানো হল ৷ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাযার সাথে রইলেন ৷ কবরস্থানে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পূর্ণ কদম মোবারক মাটিতে রাখছিলেন না, বরং পায়ের উপর ভর করেই তিনি হাঁটছিলেন ৷
দাফন কার্য সমাপ্তির পর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ অস্বাভাবিক চলার কারণ জিজ্ঞেস করলেন ৷ জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওমর! কবরস্থানে এত অধিক পরিমাণে ফেরেশতা জমা হয়েছিল যে, মাটিতে পা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না
শিক্ষা:
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা!আপনারা একটু লক্ষ্য করে দেখেছেন কি? একজন মানুষের মধ্যে কি পরিমান আল্লাহর ভয় থাকলে সে একটিমাত্র গুনাহ করে এত বেশি পরিমাণে অস্থির হয়ে পড়তে পারে? বস্তুত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম আর আমাদের মাঝে মূল পার্থক্য এখানেই ৷ তারা অনিচ্ছায় কিংবা ভুলবশত কোন পাপ করে ফেললেও তা মাফের জন্য যেকোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকতেন ৷ যে কোন কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নিতেন ৷
আর আমরা অবলীলায় হাজার গুনাহ করে যাচ্ছি ৷ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ অহরহ অমান্য করছি ৷ কিন্তু কই? আমাদের মাঝে তো এমন পরিবর্তন আসে না ৷ গুনাহ হয়েছে জানার পরও তা মাফের জন্য এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়ি না ৷
যেমন ধরুন আপনি হয়তো আগে জানতেন না, দাড়ি সেভ করলে, অধীনস্থ মেয়েদেরকে বেপর্দায় রাখলে, গান শুনলে, টিভি দেখলে, কবিরা বা জঘন্য রকমের গুনা হয় ৷ কিন্তু যখন জানলেন যে, এসব কাজ করলে কবিরা গুনাহ হবে , সম্মুখীন হতে হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির- তখন কি আপনি সাথে সাথে তওবা করেন? আপনি কি তখন প্রতিজ্ঞা করেন যে, এসব কাজ আর কোনদিন করব না, দাড়ি কাট -ছাট করব না, বেপর্দায় চলব না, নামাজ ছাড়বো না, অধিনস্থ মহিলাদেরকে পর্দাহীন ভাবে ঘুরতে দেবনা, টিভি, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ভিসিডি দেখব না? ইত্যাদি ৷
যদি এরূপ প্রতিজ্ঞা করতেন এবং সাথে সাথে তা বাস্তবায়ন করার জন্য যথাসম্ভব সবকিছুই করতেন, তবে কি আল্লাহ তাআলা আপনার উপর অধিক খুশি হতেন না? এরূপ প্রতিজ্ঞা কি আপনার দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ বয়ে আনত না? অবশ্যই ৷ অবশ্যই ৷
COMMENTS